গত কয়েক দশক ধরেই ইউরোপে মুসলিম অভিবাসীরা রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কখনও মিডিয়ায় প্রোপাগাণ্ডা তো কখনও ক্ষমতাবানদের কঠোর সিদ্ধান্তে ঢাকা পড়েছে অভিবাসীদের বাস্তব চিত্র। নানা কৌশলে মুসলিম অভিবাসীদের উচ্ছেদ করার নীল নকশা নিয়ে এগুচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। মসজিদে আজান এবং নামাজ নিষিদ্ধকরণ, হিজাব পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইসলাম প্রচারে বাঁধা দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর নিত্য দিনের ঘটনা। পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা ঠিক কিরকম? ইসলামী সমাজ বিপ্লবের প্রতি ইউরোপীয়দের কেন এতো বিদ্বেষ? সেই সবকিছু সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে আমাদের আজকের ভিডিওতে।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে খ্রিস্টান ধর্মের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হলো ইসলাম। দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও তাদের মত প্রকাশের অধিকার নেই, ধর্ম পালনের স্বাধীনত নেই। ইউরোপের অনেক রাস্তায় এখনো হিজাব পরা নারীকে বিদ্রুপ শুনতে হয়, মুসলিম পুরুষরা শুধু মাত্র দাড়ি রাখার কারণে চাকুরিচ্যূত হয়, স্কুলে মুসলিম শিশুরা পরিচয় লুকিয়ে রাখে, যেন বৈষম্যের শিকার না হয়। ইউরোপে মুসলিমরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এটা নতুন কোন অভিযোগ নয়। কিন্তু এই বৈষম্যের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে নারাজ গ্লোবাল মিডিয়াগুলো। আর এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইসলামোফোবিয়া।
ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম আতংক পশ্চিমা বিশ্বে এখন বহুল আলোচিত এক বিষয়৷ দশকের পর দশক ধরে ইউরোপের মিডিয়াগুলে মুসলিম অভিবাসীদের নেগেটিভ ইমেজ তৈরি করে এসেছে। পশ্চিমা মিডিয়ার এই অপপ্রচার মুসলিম শব্দটিকে আতঙ্ক, জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের সাথে প্রায় সমার্থক করে দিয়েছে। ইউরোপীয় টেলিভিশন, পত্রিকা এবং অনলাইন মিডিয়ায় মুসলিমদের উল্লেখ করার সময় প্রায় ৭০% রিপোর্টই হয় সন্ত্রাসবাদ, অপরাধ বা সমাজের সংকট নিয়ে। মিডিয়াগুলোর এই প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইডেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের জনসংখ্যার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হবে মুসলিম। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, আগামী শতাব্দীতে ইউরোপের কয়েকটি দেশ হবে মুসলিম-প্রধান। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো যদি মুসলিম-প্রধান হয় তাহলে পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাটা পড়বে। আর এই একটি কারণেই পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হচ্ছে মুসলিমরা।
বিশ্বব্যাপী নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে মুসলিমদের মাথা তুলে দাড়াতে দিতে চায় না পশ্চিমারা। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতিতে সীমাহীন সাফল্য নিয়ে বিশ্ব সভ্যতার একক কর্তা সেজে বসেজে আজ পশ্চিমারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তারাই এখন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিমদের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে পশ্চিমারা নিজেদের সভ্যতা হারাবে। মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী নতুন করে যে খেলাফত কায়েমের স্বপ্ন দেখে তা পশ্চিমাদের একচ্ছত্র অধিপত্যের প্রতি পরিস্কার মৃত্যুর ঘন্টা । তাই পশ্চিমারা মুসলমানদের এই চেষ্টাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে চলছে।
ইউরোপজুড়ে ইসলামফোবিয়ার বিস্তার একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বেশ কয়েকটি গভীর কারণ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, বিশ্বজুড়ে অভিবাসন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ২০১৭ সালে Muslim Ban ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর প্রভাব পড়ে ইউরোপের অভিবাসন নীতিতেও।
ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম অভিবাসীদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরে জনমত গঠনের চেষ্টা করে আসছে বহুদিন ধরেই। রাজনৈতিক দলগুলো ইউরোপের স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে প্রতিযোগিতার ভয় জাগিয়ে রেখেছে। ইউরোপীয়রা মনে করেন, মুসলিমরা তাদের অর্থনীতি, চাকরি, শিক্ষা, সুযোগ-সুবিধা সব বিষয়ে ভাগ বসাচ্ছে। আর এই প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে মনোভাব তৈরিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।
মূলধারার মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলো শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণেই মুসলমানদের খারাপ চিত্র দেখার। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ মুসলিম ইউরোপে এসেছে নিরাপত্তা খোঁজার জন্য, উন্নত জীবনের আশায় এবং তারা কঠোর পরিশ্রম করে সমাজে অবদান রাখছে।
বর্তমানে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক উন্নত। তারা ছুটছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। নতুন নতুন গ্রহ-উপগ্রহ আবিষ্কার করছে। তাদের আবিষ্কারের সুবাদে পুরো পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। ইউরোপীয়দের এ জ্ঞানের হাতেখড়ি হয়েছিল মুসলমানদের ইউরোপে পদচারণার মধ্য দিয়ে। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলিমরা শীর্ষে ছিলেন। সমাজ-সভ্যতা বিনির্মাণে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ইউরোপ আজকের যেই আকাশচুম্বী উন্নতির শেখরে পৌঁছেছে তার পেছনে মুসলিম সভ্যতার রয়েছে এক অনবদ্য ভূমিকা। তাই ইউরোপীয়দের উচিত মুসলমানদের বাস্তব চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং তাদের যোগ্য অধিকার নিশ্চিত করা।
মন্তব্য করুন